তওবা করার নিয়ম | তওবার দোয়া

তওবা করার নিয়ম হলো: নিজের পাপের কথা স্মরণ করে একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করা। এবং পুনরায় সেই অপরাধ না করার অঙ্গীকার করা। একনিষ্ঠভাবে তওবা করলে আল্লাহ তা'আলা তা কবুল করেন। তওবা করার নিয়ম সম্পর্কে আরো বিস্তারিত তথ্য নিচে তুলে ধরা হবে।

তওবা কি | তওবা করার নিয়ম

তওবা করার নিয়ম সম্পর্কে আলোচনা করার পূর্বে তওবা কি? তা জেনে নেওয়া উচিত। তাই প্রথমে তওবা কি? সে সম্পর্কে আলোকপাত করা হবে। এরপরে তওবা করার নিয়ম সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা তুলে ধরা হবে। যাইহোক আসুন দেখে নেয়া যাক, তওবা কি?

তওবা আরবি ভাষার একটি শব্দ। তওবা অর্থ ফিরে আসা। শয়তানের ধোকায় পড়ে মানুষ আল্লাহ তাআলার অবাধ্য হয়ে বিপথে চলে যায় বা পথভ্রষ্ট হয়ে যায়, অতঃপর নিজের ভুল বুঝতে পেরে সঠিক পথে অর্থাৎ আল্লাহ তায়ালার পথে ফিরে আসাকেই তওবা বলে।

ইস্তেগফার অর্থ: ক্ষমা প্রার্থনা করা, ক্ষমা চাওয়া ইত্যাদি। অতীতের গুনাহের জন্য লজ্জিত হয়ে আল্লাহ তায়ালার কাছে মিনতি করা, এবং নিজের গুনাহের কারণে অন্তরে ব্যথা অনুভব করা। আল্লাহ তাআলা গাফফার অর্থাৎ ক্ষমাশীল। তিনি বান্দাদের ক্ষমা করতে ভালোবাসেন। যদিও বান্দর গোনাহ অনেক বেশি হয়ে যায়।

তওবা করার নিয়ম হলো: ওযু করে পাক পবিত্র হয়ে তওবার উদ্দেশ্যে অন্যান্য নফল নামাজের মত দুই রাকাত নামাজ পড়ে আল্লাহর নিকটে নিজের সারা জীবনের পাপের কথা স্মরণ করে ক্ষমাপ্রার্থনা করা। (এ নামাজের নির্ধারিত কোন সূরা নেই যে কোন সূরা দিয়ে পড়া যায় এবংআল্লাহ তায়ালার দরবারে কাকুতি মিনতি করে নিজের কৃত গুনাহের জন্য খাঁটি দিলে  তওবা করা।

তাওবা ও ইস্তেগফারের ফজিলত

তাওবা ও ইস্তেগফারের ফজিলত অত্যাধিক। একজন ব্যক্তি যখন তার পাপের কথা স্মরণ করে তওবা করতে মনস্থ করে তখন ধরে নিতে হবে যে সে আল্লাহকে ভয় করে। এবং আল্লাহর শাস্তি থেকে নিজেকে রক্ষা করার জন্য তওবা বা ইস্তেগফার করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। আর এ কারণেই  আল্লাহ তায়ালা তাওবাকারীকে অনেক বেশি পছন্দ করে থাকেন। তাওবা ও ইস্তেগফারের যে সকল ফজিলত রয়েছে সেগুলো নিচে লিস্ট আকারে তুলে ধরা হলো। 


১. তাওবা ইস্তেগফার উভয় জাহানের সফলতার কারণ: তওবার মাধ্যমে সফলতা অর্জন করা যায়। এই প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ তা'আলা বলেন, واتوبوا الى الله جميعا ايها المؤمنون لعلكم تفلحون অর্থ: "হে মুমিনগণ তোমরা সকলেই আল্লাহ তায়ালার কাছে তওবা করো যাতে তোমরা সফলতা অর্জন করতে পারো" (সূরা নূর আয়াত ৩১)

২. বান্দার খাটি তওবার মাধ্যম তার কোন সমহ মাফ হয়ে যায়: তায়ালা বলেন, يا ايها الذين امنوا توبوا الى الله توبه نصوحا عسى ربكم ان يكفره عنكم سيئاتكم ويدخلكم جنات تجري من تحتها الانهار الخ অর্থ: হে ঈমানদারগণ তোমরা আল্লাহ তাআলার নিকটে খাঁটি তওবা কর খাঁটি তওবা আশা করা যায়, তোমাদের প্রতিপালক তোমাদের সকল গুনাহ মাফ করে দিবেন এবং তোমাদেরকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন যার তলদেশে না হওয়ার নাহর সমূহ প্রবাহিত। (সূরা তাহরীম ৮)

৩. তওবার মাধ্যমে গোনাহ সমুহ পুণ্য দ্বারা পরিবর্তন করে দেওয়া হয়: الا من تاب وامن وعمل صالحا فاولئك يبدل الله سيئاتهم  حسنات وكان الله غفور رحيم কিন্তু যারা তওবা করে এবং ঈমান আনে ও নেক আমল করে তাদের গুনাহ সমূহ অন্য দ্বারা পরিবর্তন করে দিবে এবং আল্লাহ তায়ালা ক্ষমাশীল পরম দয়ালু। (সুরা  ফুরকান ৭০) 

৪. তাওবা ইস্তেগফার কারণে উৎকৃষ্ট জীবন উপকরণ, বৃষ্টি বর্ষণ, শক্তি বৃদ্ধি,সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি লাভ হবে: আল্লাহ তাআলা বলেন, وان يستغفروا ربكم ثم توبوا اليه يمتعكم متاعا حسنا الى اجل مسمى ويؤت كل هذه فضل وان تولوا فاني اخاف عليكم عذاب يوم كبير، আর এই যে, তোমরা তোমাদের প্রতিপালকের নিকট ক্ষমাপ্রার্থনা করো অতঃপর তার দিকে নিবিষ্ট হও তাহলে আল্লাহ তায়ালা তোমাদেরকে নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত উৎকৃষ্ট জীবন উপকরণ দান করবেন এবং প্রত্যেক আমলকারীকে বেশি দান করবেন আর যদি তোমরা মুখ ফিরিয়ে নাও তাহলে আমি তোমাদের উপর বড়দিনের শাস্তির ভয় করতেছি।(সূরা হুদ আয়াত ৩)
অন্য আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেন, يا قوم استغفروا ربكم ثم توبوا اليه يرسل السماء عليكم مدرارا ويزيدكم قوه الى قوتكم ولا تتولوا مجرمين، অর্থ হে আমার সম্প্রদায়, তোমরা তোমাদের পালনকর্তার নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করো অতঃপর তার কাছেই তওবা কর তাহলে আল্লাহ তাআলা তোমাদের উপর থেকে বৃষ্টি পাঠাবেন এবং তোমাদের শক্তির সাথে আরও শক্তি বৃদ্ধি করে দিবেন এবং তোমরা অপরাধী হয়ে মুখ ফিরিয়ে নিও না। (সূরা হুদ আয়াত ৫২)

৫. তাওবা ও ইস্তেগফারের মাধ্যমে সকল প্রকার চিন্তা থেকে মুক্তি পাওয়া যায়: হাদিস শরীফে রাসুল আকরাম সাঃ এরশাদ করেন,  من لزم الاستغفار جعل الله له من كل هم فرجا ومن كل ضيق مخرجا ورزقه من حيث لا يحتسب، অর্থ যে ব্যক্তি নিয়মিত ইস্তেগফার পড়বে আল্লাহ তায়ালা তাকে প্রত্যেক বিপদ থেকে মুক্তি দান করবেন সকল দুশ্চিন্তা থেকে মুক্তির ব্যবস্থা করুন এবং এমন উৎস থেকে রিজিকের ব্যবস্থা করবে যা সে কল্পনাও করতে পারবেন।

অন্য বর্ণনায় আছে, طوبي لمن وجد في صحيفته استغفار كثيرا، অর্থাৎ ওই ব্যক্তির জন্য সুসংবাদ যার আমলনামা য় বেশি ইস্তেগফার পাওয়া যাবে। অন্যত্র বলা হয়েছে, التائب من الذنب كما الله ذنب له অর্থ গোনা থেকে তওবা কারী  ওই ব্যক্তির যার কোন গুনা নেই।

৬.তওবা কারীকে আল্লাহ তায়ালা ভালোবাসেন:  ان الله يحب التوابين ويحب المتطهرين، অর্থাৎ নিশ্চয়ই আল্লাহ তায়ালা তওবাকারীকে ভালোবাসেন এবং পবিত্রতা অর্জনকারীকে ভালোবাসেন।

৭. আল্লাহ তাআলা তওবার ফলে  খুশি হন: বান্দার তাওবার ফলে আল্লাহ তাআলা এত বেশি খুশি হন যে যার উদাহরণ দিতে গিয়ে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু সালাম বলেন যে, কোন মুসাফির সফরের আসবাবপত্র ও উট সহ কোন মরুভূমিতে বিশ্রামের জন্য গাছের ছায়ায় মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়ল, ঘুম থেকে উঠে দেখল তার উট হারিয়ে গেছে অনেক খোঁজাখুঁজির পর উট না পেয়ে ক্ষুধা পিপাসায় কাতর হয়ে পুনরায় ওই গাছের নিচে ঘুমিয়ে পড়ল, ঘুম থেকে উঠে দেখল যে, তার উট খাদ্য পানি সহ দাঁড়িয়ে আছে তখন সে খুশিতে বলে উঠলো আল্লাহ তুমি আমার বান্দা আমি তোমার প্রভু। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাই সাল্লাম বলেন যে, কোন ব্যক্তিত তওবা করলে আল্লাহ তায়ালা উট হারনেওয়ালা ব্যক্তির চেয়েও বেশি খুশি হন।  (বুখারি ও মুসলিম)

তওবা করার শর্ত

তওবা করার নিয়ম সম্পর্কে ইতোমধ্যেই উপরে বিস্তারিত আলোচনা তুলে ধরা হয়েছে। নিচে তওবা করার শর্ত সমূহ তুলে ধরা হবে। তওবা করার নির্ধারিত শর্ত রয়েছে। আপনি যদি তওবা করতে চান তাহলে আপনাকে অবশ্যই সেই শর্তগুলোর যথাযথভাবে অনুসরণ করার পরে তওবা করতে হবে। তওবা করার জন্য যে সকল শর্ত রয়েছে সেগুলো নিচে বিস্তারিত হবে তুলে ধরা হলো। আসুন জেনে নেয়া যাক, তওবা করার শর্ত সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য। 

তওবা করার শর্ত তিনটি:

১.  অতীতের কৃত গোনাহের জন্য লজ্জিত হওয়া অনুতপ্ত হওয়া
২. যে গুনাহ থেকে তওবা করা হয় সেই গুনাহ ছেড়ে দেওয়া।
৩. ভবিষ্যতে গোনাহে লিপ্ত না হওয়ার দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করা।

যদি বান্দার হকের সাথে সম্পর্কিত গুনাহ হয় তাহলে তার হক তাকে ফিরিয়ে দিতে হবে কিংবা তার কাছে ক্ষমা চাইতে হবে। বান্দা মাফ না করা পর্যন্ত আল্লাহতালা উক্ত গোনাহ ক্ষমা করবেন না।
উল্লেখিত শর্ত সাপেক্ষে খাঁটিয়ে দিলে তাওবা করলে আল্লাহ তা'আলা অবশ্যই মাফ করে দিবেন।

তওবার দোয়া | এস্তেগফারের দোয়া 

তওবা করার জন্য অনেক দোয়া রয়েছে। নিচে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ তওবার দোয়া বা এস্তেগফারের দোয়া তুলে ধরা হবে। তওবা করার জন্য সর্বশ্রেষ্ঠ যেই দোয়াটি রয়েছে সেই দোয়াটি সহ আরো কয়েকটি দোয়া নিচে উল্লেখ করা হলো। আসুন দেখে নেয়া যাক, তওবার দোয়া বা এস্তেগফারের দোয়া সমূহ। 


এক. 

اللهم انت ربي لا اله الا انت خلقتني وانا عبدك وانا على عهدك ووعدك ما استطعت اعوذ بك من شر ما صنعت ابوأ لك بنعمتك علي وابو لك بذنبي فاغفر لي فانه لا يغفر الذنوب الا انت،
উচ্চারণ:  আল্লাহুম্মা আনতা রাব্বি লা ইলাহা ইল্লা আনতা খালাক্বতানী ওয়া আনা আবদুকা ওয়া আনা আলা আহদিকা ওয়া ওয়াদিকা মাসতাতা"তু আউযুবিকা মিন সাররি মা ছনা'তু আবুউলাকা বিনি'মাতিকা আলাইয়া ওয়া আবুল লাকা বি যাম্বী থাক ফিরলি ফাইন্নাহু না ইয়াগফিরুজজনুবা ইল্লা আনতা।
হাদিস শরীফে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন যে, কোন ব্যক্তি যদি  সন্ধ্যায় এই দোয়া পড়ে আরওই রাত্রেই মারা যায় তাহলে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে এবং কোন ব্যক্তি যদি সকালে পাঠ করে এবং ওই দিনেই মারা যায় তাহলে সে ব্যক্তি জান্নাতে প্রবেশ করবে। (এই দোয়াটিকে বলা হয় সাইয়েদুল ইস্তেগফার বা তওবার সর্বশ্রেষ্ঠ দোয়া) 

দুই.

استغفر الله الذى لا اله الا هو الحي القيوم واتوب اليه 
উচ্চারণ: আস্তাগফিরুল্লাহাল্লাজি লা ইলাহা ইল্লা হুয়াল হাইয়ুল কাইয়ুম ওয়া আতুবু ইলাইহি।

শরীফে এসেছে যে ব্যক্তি এই দোয়া ইখলাস এর সাথে পাঠ করবে তার গুনাহ যদি সাগরের ফেনা পরিমাণও হয় আল্লাহ তায়ালা মাফ করে দিবেন। অন্য বর্ণনায় আছে যে ব্যক্তি ইস্তেগফারের এই দোয়া পড়বে তার সব গুনাহ মাফ করে দেওয়া হবে যদিও সে জিহাদের ময়দান থেকে পালিয়ে যায়।

তিন.

 استغفر الله ربي من كل ذنب واتوب اليه
উচ্চারণ: আস্তাগফিরুল্লাহ রাব্বি মিন কুল্লি জাম্বিউ ওয়া আতুবু ইলাইহি।

চার. 

استغفر الله واتوب اليه
উচ্চারণ: আস্তাগফিরুল্লাহ ওয়া আতুবু ইলাইহি।

শেষ কথা

তওবা করার নিয়ম এবং তওবার দোয়া সম্পর্কে ইতোমধ্যেই উপরে বিস্তারিত আলোচনা তুলে ধরা হয়েছে। তাই আপনি যদি প্রথম থেকে সম্পূর্ণ আর্টিকেলটি মনোযোগের সাথে পড়ে থাকেন তাহলে অবশ্যই তওবা করার নিয়ম এবং তওবার দোয়া জানতে পেরেছেন। তথ্যবহুল গুরুত্বপূর্ণ এই আর্টিকেলটি সকলের সাথে শেয়ার করতে পারেন। এতে করে অন্যরাও তওবা করার নিয়ম সম্পর্কে জানতে পারবে।
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url